কল্পনার আড়ালে ভবিষ্যৎ - অভিজিৎ সাহা

কল্পনার আড়ালে ভবিষ্যৎ
          অভিজিৎ সাহা
                  
                    
        একটি গ্রামে এক রাজা ছিলেন। রাজার শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত যুক্তি ও সংবেদনের আর প্রতিবাদীরও। রাজা যেমন গ্রামের মানুষদেরকে ভালোবাসতেন ঠিক তেমনই গ্রামের মানুষগুলি রাজাকে দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধ্যা করতেন। রাজার সততা, মানবিকতা, নৈতিকতা ও সত্যতা গ্রামের ছোট থেকে বড় সবাইকে বৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু হ্যাঁ রাজা কখনো অন্যায়কে মেনে নিতে পারেননি। অন্যায়কারীদের কঠোরতম শাস্তি তিনি যথাভাবে প্রদান করতেন। 

বেশ চলছিল রাজার স্থায়িত্ব শাসন ও ব্যবস্থা। একদিন রাজার দুই মন্ত্রীরা মিলে রাতের অন্ধকারে গ্রামের গরীব চাষীদের ওপর হামলা করে, তাঁদের সম্পদ চুরি করে আত্মসাৎ করেন। পরেরদিন রাজার কাছে চাষীদের করুন মিনতি আসে যে রাজাবাবু আমাদের জমানো সব সম্পদ লুঠ হয়েছে গতরাতে আমরা খাবো কি রাজামশাই, কিছু উপায় বলে দিন, আমরা যে অসহায় দিনমজুর। দিন আসলেই আমরা খেতে পাই। তখন রাজাই বলেন যারা যারা এই কাজ করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে এবং আপনাদের মূল সম্পদ দিয়ে দেওয়া হবে  আপনারা নিশ্চিন্তে বাড়িতে যেতে পারেন। গরীব চাষীরা যথারীতি বাড়ীতে পৌঁছায় এবং রাজার দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে তাঁরা শান্ত হয়। 

আমার গ্রামের মানুষদের লুন্ঠন! রাজা ব্যাপারটাকে কোথাও মানতে পারছেন না। বেশ আলোকপাত করেন এবং সকল মন্ত্রীদেরকে তাঁর সভায় বলেন প্রতিনিয়ত তদারকি করতে, এ কাজ তিনি কোনমতেই বরখাস্ত করবেন না। কিছুদিন পর রাজার কাছে খবর আসে যে আপনার সহ মন্ত্রীরা এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি গোপনে বিধস্ত হোন এবং যদি সে কথা সত্যি ই হয় তাহলে যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখবেন কথা দেয়।
 
মাসখানেক পর রাজার দুইমন্ত্রীর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি বুঝে ফেলেন তাঁরই মন্ত্রী ভালো মানুষের মুখোসে এই কর্ম চালিয়েছেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁদেরকে বন্দীবাসের ঘোষণা করেন, মন্ত্রী রা কারাবাসে গেলে তাঁরা অপর আরেকজনকে মিথ্যে দোষারোপে (অতীতের হিংসাত্মক মনে রেখে) করেন।

পরেরদিন রাজা শাস্তির অভয়বাণী হিসাবে রাখেন-মন্ত্রীরা আজ পাশ্ববর্তী বন থেকে আগামী এক বছরের জন্য যেকোনো খাবার সংগ্রহ করবেন আর একবছরে তাঁদেরকে বাইরে আসার কোনরকম অনুমতি দেওয়া থাকবে না। প্রস্তাব শোনা মাত্রই প্রথম মন্ত্রী বনের যতরকম কাঁচাফল সংগ্রহ করে ফেলে, দ্বিতীয় মন্ত্রী বনের সমস্ত বৃক্ষকে লুঠ করে নেয় জ্বালানীর জন্যে। আর শেষ মন্ত্রী যিনি বিনা কারণে দোষী ছিলেন তাঁর ভাবনাতে ছিল 'পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুধা একটুখানি সাজিয়ে দেওয়া; বনের বাগান থেকে কয়েক চারা গাছ তুলেছিলেন মাত্র। নিজের জন্যে নয় ভবিষ্যতের জন্য। তারপর একে একে রাজার কারাবাসের দরবারে উপস্থিত হোন তিনমন্ত্রী। রাজা তৃতীয় সাজাপ্রাপ্য মন্ত্রীকে দেখে হতভম্ভ, বললেন; এ কি মন্ত্রী তুমি সামান্য কয়েক চারা নিয়ে এলে এতেই কি তোমার এক বছরের জোগান হয়ে যাবে? রাজার অপ্রত্যাশা প্রশ্নের উত্তর দিলেন স্বয়ং মন্ত্রী- রাজামশাই, আমি তো চোর নয়, আমি বরং আপনার শ্রদ্ধ্যায় আদেশ পালন করেছি মাত্র, আর আমি জানতাম আপনি সেই আগের মতন এক শাস্তি বহাল রাখবেন তাই নিঃশ্চুপ ছিলাম। একটু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি, করতে দিন _প্রকৃতির কাছে আমরা কি চরম ঋণী; তার থেকে অঢেল সম্পদের বিপুল লোভ নিয়ে আমরা ক্রমশঃ ছুটেই চলেছি, ছুটছি আর ছুটছি, আমৃত্যু অবধি আমাদের যাত্রা থামার নয়, তা অপার, বন্ধ নেই মানুষে রাজের গতি; আর দেখা নেই সৈজন্য, ভালোবাসা সমুদয় সাগরতীরে ডুব দিয়েছে! নিঃশ্বাস টুকু বেঁচে রয়েছে বাকি সকল অলৌকিক। একথা শুনে রাজা খানিক বিস্মিত হলেন। মন্ত্রী তাঁর মননের কথা কোথাও থামতে পারছেন না যেন কোথা দিয়ে আবির্ভূত অনাড়ম্বর মেরুদন্ডের মতো কথা বুঝতেই পারছেন না। 
তিনি বলেন, মহারাজ আমরা কিসের দৌড়ে এই কঠিন প্রতিযোগিতায় নেমেছি বলতে পারেন? না, আমাদের কাছে কোনো উত্তর নেই আজও! নেই কোনো সমাধানের পথ। শুধু ধারালো অস্ত্রের ছুরি দিয়ে কোপ দিচ্ছি যুগের পর যুগকে। এই শিক্ষায় কি কোলের শিশুকে দেবো? কিভাবে বাঁচবে ওরা? কি রাখছি শিশুর জন্যে। চারিধার আঁধারে আঁধারে কালছিটে, বিপন্নের ছবি আমাদের মুখস্থ করতে হচ্ছে এটাই কি পৃথিবীর রঙ ছিল? ছিল না! ষড়যন্ত্র করে রঙ লাগিয়েছি।
তাই এই ছোট্ট ছোট্ট গাছগুলিকে এনেই পশু-পাখির বাঁসা দেবো, হাঁটতে পারা শিশুর হাসি দেবো, দোলনা দেবো, আর আশ্রয় দেবো মানুষ থেকে মানুষের। এটাই আমার কাছে অনেক বড় কিছু  ইশারা মৃত্যুর আগে অবধি আমি এগুলির পূর্ণ আনন্দ নিতে চাই আপনি শুধু গাছ বসানোর আজ্ঞা দেন মহারাজ। রাজামশাই একথা শুনে চোখের জলের  চিৎকার আর ধরে রাখতে পারেননি। বললেন তোমার মতো মন্ত্রী পেয়ে আমি ধন্য, গর্বিত। তোমার রাজার আসনে বসার যোগ্য। আমি-আমরা এতদিনে নিজেদের ভেবে গেছি প্রতিমুহূর্ত একবারও ভবিষ্যতের দিনগুলির কথা মনেও আনি নি। রাজা তাঁর শেষ কথাতে বলেন তুমি মন্ত্রী নয় তুমি এক রেখা যে রেখার শিরোনাম তোমার মহিমায়- যাঁর ভাবনা-চিন্তার প্রকৃতি আগামী শিশুর তরে তার মৃত্যু শুধু মহত্ব চিনিবার জন্যে হয়।। ......


    (ছোটগল্প অবলম্বনে)
নীতিকথা- যাঁর চিন্তা যতই বড় তার ভবিষ্যৎ ততই মহান ।

Comments

Popular posts from this blog

আলোর দিশা সাহিত্য পত্রিকা - জানুয়ারী সংখ্যা ২০২৪

মাটির শহর - সৌভিক দেবনাথ

কবি বিকাশ ভৌমিকের কবিতা