বাঙালীর মাছ খাওয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে - দীপ ঘোষ
বাঙালীর মাছ খাওয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে
দীপ ঘোষ
ঈশ্বর গুপ্ত বলেছেন " ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল "
কখন থেকে মাছ খাওয়া চালু হয়, তার কোন প্রমান মুলক তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তবে খাল বিল নদী নালার দেশ বঙ্গ দেশে মাছ বোধ হয় আগাহরাই খাওয়া হতো । সেই জন্যই বাঙালীর সাথে ভাত ও মাছ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । চন্দ্রকেতুগড়ে মাছের ছবি-সহ একটি ফলক পাওয়া গেছে । নীহাররঞ্জন রায়ের ধারনা, এই ফলকটি চতুর্থ শতকের । তা ছাড়া, অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর ও ময়নামতি তে যেসব পোড়া মাটির ফলক তৈরি হয় তার অনেক গুলতেই মাছের ছবি আছে । এই থেকে মাছের প্রতি এই অঞ্চলের লোকেদের ভালবাসার পরিচয় পাওয়া যায় ।
বাংলাদেশের ধর্মভীরু ব্রাহ্মণেরা বোধ হয় পাহাড়পুরের আমলে মাছ খেতেন না । সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীন বাংলা সমাজে মাছ- মাংস জনপ্রিয় ছিল মূলত অব্রাহ্মণদের মধ্যে । কিন্ত কই, রুই অথবা ইলিশসের মতো মুখরোচক খাবার অথবা দেশের জনপ্রিয় রীতিকে কেবল ধর্মের নাম দূরে ঠেকিয়ে রাখা সহজ ছিল না । সেই কারণ দশ কি এগারো শতকে বাঙালি শাস্ত্রকারদের মধ্যে একজন - ভবদেব ভট্ট প্রমান করতে চেষ্টা করেছিলেন যে, মাছ খাওয়া কত ভালো । এর পরিপেক্ষিতে অনেক যুক্তিও দেওয়া চেষ্টা করেছিলেন তিনি । বৃহদ্ধর্ম্মপুরানে বলা হয়েছে রুই, পুঁটি , শোল, সাদা রঙের এবং আঁশওয়ালা মাছ ব্রাহ্মনেরাও খেতে পারেন । বলা হয়, উদ্ভট শ্লোক রচিত হয়েছিল বারো শতকে বা তার কিছু কাল পরে । এতে মাছ খাওয়া রীতিমতো প্রশংসা করা হয়েছে প্রাকৃতপৈঙ্গলে । এর একটি পদে বলা হযেছে যে, যে - নারী রোজ কলা পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর নালিতা শাক পরিবেশন করেন, তাঁর স্বামী পুণ্যবান (অর্থাৎ ভাগ্যবান) ।
মাছ বাঙালিদের কাছে এত প্রিয় হওয়ার জন্যই বাঙালি গৃহিণীরা বিশেষ যত্ন দিয়ে নানা ভাবে মাছ রান্না করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন । বাংলা ভাষায় সবচেয়ে পুরানো রান্নার বই ' পাক রাজেশ্বর ' প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শতকে । এরপর ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ' পাক - প্রণালী ' । দুই বইতেই মাছ রান্না বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর রান্নার বইতে মাছের ৫৮ রকমের রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন । এই থেকে বাঙালির মাছের প্রতি কতো আকর্ষণ তার পূর্ণ আভাস পাওয়া যায় ।
মাছের প্রতি এই ভালোবাসা জন্য প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালিদের মাছ - খেঁকো বলে অনেকে দুর্নাম করেছেন । সর্বানন্দও তাদেরই একজন । টীকাসর্বস্বে তিনি লিখেছেন যে, শুটকি মাছ হলো নিন্মবঙ্গ লোকেদের খুবই প্রিয় খাদ্য । এই জন্য তিনি বাঙালিদের শুটকি - খেঁকো বলেছেন । গোলাম হোসেন সালিম ১৭৮০-এর দশকে তাঁর ' রিয়াজ - উস সালাতনী ' তিনি লিখেছেন যে " এ দেশের উঁচু - নিচু সবাই মাছ, ভাত, সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পসন্দ করে । প্রচুর লাল মরিচ ও লবন তাদের পছন্দ । তারা আদেও গম বা যবের রুটি খায় না । ঘিয়ে রান্না খাসি বা মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না " ।
মধ্যযুগের সাহিত্যে মাছের যা বিবরণ পাওয়া যায়, তা বিস্তারিত । বিশেষ করে ভরতচন্দ্রের তালিকা রীতিমত দীর্ঘ । আধুনিক কালে বিদেশ থেকে আনা কিছু মাছের কথা বাদ দিলে , অন্য সব মাছের সাথে বাঙালিদের পরিচয় ছিল সেটা সেই যুগের সাহিত্য থেকে জানা যায় । পদ্মাপুরান, চন্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ভরতচন্দ্র ও ঈশ্বরগুপ্ত মিলিয়ে যেসব মাছের কথা জানা যায় সেগুলি হলো: আড়, ইচা, ইলিশ, উলকা, এলেঙ্গা, কাতল, কালবসু, কুড়িসা, কৈ, খয়রা, খোরশোলা, খলিশা, গড়ুই, গাগর, গাঙ্গদাঁড়া বা কাকলেকা, চাঁদা, চান্দাগুড়া, চিঙড়ি, চিতল, চেঙ্গ, চেলা, ট্যাংরা, ডানিকোনা, তাপস, পাঁকাল, পাঙ্গাশ, পাবদা, পার্শে, পুঁটি, ফলুই, বাঁশপাতা, বোয়াল, বাচা, বাটা, বান, বানি, বেলে, ভেকুট, ভেদা, ভোলচেঙ্গা, ভোলা, ময়া, মহাশোল, মাগুর, মৃগেল, মৌরলা, রিঠা, রুই, লাটা, শঙ্কর, শাল(গজাল), শিঙ্গি, শোল । এইসব মাছের বাইরে বিশ শতকে গোড়ায় সতীশচন্দ্র শাস্ত্রী যেসব মাছের তালিকা করেছিলেন, সে গুলি হলো: অঞ্জনা, আলবুলা, আরশি, কটকটিয়া, করাতি, কাঁকাল, কাকাশিয়া, করসি, কুরচি, ঘাগৌট, ঘারুয়া, চন্দ্রামারা, চাকুন্দা, চাপলি, টেপা, তর, দেওকাটা, দেবারি, নফেলা, পটকা, পান, ফেঁসা, ভাঙ্গন এবং শিলন্দ ।
সেকালের সাহিত্য থেকে কেবল বিচিত্র ধরণের মাছের নামিই জানা যায় না, সেই সঙ্গে আরো জানা যায়, খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য কতো বিচিত্র ভাবে মাছ রান্না করা হত । যেমন, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল থেকে মাছ রান্নার রকমারি সম্পর্কে অভাস পাওয়া যায় । খুল্লনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনারও পর যেসব মাছের রান্না হয়েছিল, তার বিবরণ দিয়েছেন কবি:
' সরষের তেলে চিতল মাছের কোল ভাজা; কুমড়ো বড়ি আর আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল; আদারস দিয়ে সর্ষে তেলে
কই মাছ ভাজা; কাতলা মাছের ঝোল; খোরশোলা মাছ ভাজা; আর শোল মাছের কাটা বের করে কাঁচা আমের সঙ্গে রান্না '
বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলেও মাছের বিভিন্ন বিভিন্ন রকম রান্নার বিবরণ দেওয়া আছে যেমন, রুই মাছ দিয়ে কাতলার আগা; মাগুর মাছ দিয়ে গিমা মাছ; ঝাঁঝালো কটু তেল তেল(সর্ষের তেল) দিয়ে খরসুন মাছ; ভেতরে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে বাইরে সুতো জড়িয়ে চিঙড়ি মাছের মাথা; চিতল মাছের কোল ভাজা আর কই মাছ দিয়ে মরিচের ঝ ঝোল।
এইটুকুতেই বাঙালির মাছ খাওয়ার ইতিহাস শেষ হয়না বরং বলা যেতে পার এখান থেকে শুরু । আমি চেষ্টা করলাম শুধু মাত্র যতটা সংক্ষেপে বাঙালির সমাজে মাছ খাওয়ার ইতিহাস যতটা সহজে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার আশা সকলের ভালো লাগবে । কমেন্ট, লাইক ও শেয়ার করুন ।
*তথ্য সংগ্রহ:* গোলাম মুরশিদ - এর ' হাজার বছরে বাঙালির সংস্কৃতি '
Comments
Post a Comment