জয় জগন্নাথ - দেবারতি গুহ সামন্ত

জয় জগন্নাথ
দেবারতি গুহ সামন্ত

সকাল থেকেই টানা মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে,
মনটা একদমই ভালো নেই আদিদেভের,ছোট্ট করে আদি।
আজ রথযাত্রা,রথের চাকা ঘোরা মানেই পূজোর আগমনী সুর বাজছে,
তবু কিছুতেই অশান্ত মনটা হচ্ছে না শান্ত।

পাঁচ বছর আগে এই দিনেই আদি হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রিয়তমা আদিত্রি কে।
নামের মিল থাকায় বন্ধুরা মজা করে বলত রাজজোটক।
সত‍্যিই তাই,ওদের মতো রোমান্টিক কাপল ছিল অনেকেরই ঈর্ষার কারণ।
কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে গড়গড়িয়ে এগোচ্ছিল ওদের প্রেমের চাকা।

দুজনেই আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছে,
পাশ করে নামী কোর্টে ওকালতিও করে আদিত্রি।
কিন্তু আদিদেভ তখনও চাকরি না পাওয়ায়,
ওদের বিয়েতে বাধ সাধে আদিত্রির বাবা।

অন‍্য জায়গায় আদিত্রিকে পাত্রস্থ করা হবে এই সিদ্ধান্তে আদিত্রি নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলে,
সাথে ভগবানকে কথাও দেয় যদি ওদের বিয়ে সুসম্পন্ন হয় ও সেদিন নিজে ঠাকুরের পুজো দেবে।
শেষমেষ মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে,
আদিত্রির বাবা মেনে নেন আদিদেভকে জামাই হিসেবে।

সেই সঙ্গে শর্ত রাখেন,কোনদিন যদি তার আদরের মেয়ের এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে,
ততক্ষণাৎ তিনি এ বিয়ে ভাঙতে দুবার ভাববেন না।
শর্তে রাজি হয় আদিদেভ,ওর পুরো আত্মবিশ্বাস ছিল,
ও থাকতে আদিত্রির কোন কষ্টই হবে না।

ধুমধাম করে শানাই বাজিয়ে,আলো জ্বালিয়ে,বাজি পুড়িয়ে আদিত্রির সিঁথি রাঙিয়ে দেয় আদিদেভ।
আদিদেভের বাবা মা বোন এই বিয়েতে খুব খুশী,বিশেষ করে আদিত্রির মত এত মিষ্টি মেয়ে পেয়ে।
অষ্টমঙ্গলা করতে ওরা আদিত্রির বাড়ি যায় জোড়ে,
মেয়ের হাসিমুখ দেখে আদিত্রির বাবা প্রাণ ভরে আশির্বাদ করেন জামাইকে।

বাপের বাড়ি এসে আদিত্রির মনে পড়ে মানতের কথা,
সামনেই হানিমুনের ‍প্ল‍্যানিং,কোর্টের ছুটিও শেষ হয়ে আসছে।
অতএব রথ দেখা,কলা বেচা দুটোই করতে হলে এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে হবে,
সেই মতো গোল মিটিং এ ঠিক হল বেড়াতে যাওয়া হবে পুরি,পুজো আর মধুচন্দ্রিমা দুটোই হবে।

পাঁজিতে ঠাকুরমশাইয়ের বেছে দেওয়া শুভদিনে রওনা হয় আদিত্রি ও আদিদেভ,
ট্রেনে উঠে সব্বাইকে টাটা করে ওরা,যথাসময় ট্রেন ছেড়ে দেয়।
নতুন বউ আদিত্রির খুশী আর ধরে না,বরের সঙ্গে সমানে চলতে থাকে খুনসুটি,
লম্বা একটা সফরের পর অবশেষে ওরা পৌঁছয় শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের ধাম পুরিতে।

সামনে বিশাল সমুদ্র,বড়ো বড়ো ঢেউয়ে সাদা সাদা ফেনা,
এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রঙবেরঙের নুড়িপাথর,ঝিনুক।
এসব দেখে বাচ্চা মেয়ের মতো উচ্ছল আদিত্রি সব ক্লান্তি যায় ভুলে,
এখনি পারলে সমুদ্রে নেমে সেরে নায় স্নান,সারা গায়ে বালি মেখে।

অনেক বুঝিয়ে হোটেলে আদিত্রিকে নিয়ে ফেরে আদিদেভ,
ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে দুজনে দেয় লম্বা একটা ঘুম।
যখন ঘুম ভাঙে,সূর্য তখন পশ্চিমে অস্ত যেতে শুরু করেছে,
সারা আকাশ জুড়ে গোধূলি আলোয় কত রকম  রঙের খেলা।

ওরা অনেকক্ষণ সি বিচে বসেছিল,দুজনে একসাথে কফি খায়,
আদিদেভ আদিত্রিকে খুব সুন্দর ঝিনুকের একটা হার দেয় উপহার।
পরেরদিন রথযাত্রা,সি বিচে খুব ভীড় তাই,
তার মধ‍্যেই আদিত্রি আদিদেভের কাঁধে মাথা রেখে আগামী দিনের স্বপ্নের জাল বোনে।

পরেরদিন খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে নেয় আদিত্রি,
ওর ঘন লম্বা চুল থেকে চুঁইয়ে পড়া জলের ফোঁটায় ঘুম ভাঙে আদিদেভের।
চোখের সামনে সদ‍্যস্নাতা আদিত্রিকে দেখে মুগ্ধ আদিদেভ ফেরাতে পারে না ওর চোখ,
মৃদু ধমক দেয় আদিত্রি,তাড়াতাড়ি উঠতে বলে,পূজোর দেরী হয়ে যাচ্ছে যে।

স্নান সেরে নেয় আদিদেভ,নতুন পাজামা পাঞ্জাবী তে লাগছে দারুণ হ‍্যান্ডসাম,
চোখের কোণ থেকে কাজল নিয়ে নজরটিকা লাগিয়ে দেয় আদিত্রি।
ওর বরকে যেন কেউ নিয়ে নিচ্ছে এই ভেবে শক্ত করে জড়ায় আদিদেভের হাত,
তারপর দুজনে মিলে রওনা হয় মন্দিরের উদ্দেশ‍্যে।

লোকে লোকারণ‍্য চারিদিক,লক্ষ‍্য লক্ষ‍্য মানুষের সমারোহে নেই তিল ধারণের জায়গা,
জগন্নাথদেব যে আজ মাসির বাড়ি যাবেন রথে চড়ে,গুন্ডিচা মন্দিরে,সাথে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রা।
গজপতি মহারাজ সবার আগে ঝাঁটা হাতে পরিষ্কার করছেন রাজপথ,
সুগন্ধী জল আর চন্দনবাটায় চারিদিক হয়ে উঠছে পবিত্র।

আদিদেভ আর আদিত্রি আগে থেকে পান্ডাকে বলে রাখায় ভালো ভাবে দেয় পূজো,
ঠাকুরের মহাপ্রসাদ গজা নিয়ে ওরা জগন্নাথ দেব দর্শণের কারণে গিয়ে ঢোকে ভীড়ের মধ‍্যে।
তখন সবে রথের রশি টানা আরম্ভ হয়েছে,
পাপস্খলন করে পূণ্য অর্জনের লোভে কে রথের দড়ি ধরবে সেই নিয়ে শুরু হয় মারামারি,ধাক্কাধাক্কি।

আদিদেভ শক্ত করেই ধরে রেখেছিল আদিত্রির হাত,
কিন্তু ভক্তদের ভীড়ের চাপে,ধাক্কাধাক্কিতে টাল সামলাতে না পেরে আচমকা হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যায়।
ছিটকে পড়ে আদিত্রি,কিন্তু রাশি রাশি ভক্তদের মাঝে কেউ করে না লক্ষ‍্য,
পাগলের মতো আদিত্রিকে খুঁজতে থাকে আদিদেভ।

ভক্তরা তখন রথের দড়ি টানতে ব‍্যস্ত,জয়ধ্বনি আর ঘন্টাধ্বনিতে মুখরিত চারিদিক,
বাতাসে উড়ছে ভক্তদের উল্লাস,কে শুনবে তখন আদিদেভের কান্না?
আদিত্রির মতো আরও অনেকেই তখন ভীড়ের চাপে পরিবারের থেকে আলাদা,
লক্ষ‍্য লক্ষ‍্য মানুষের পায়ের তলায় হচ্ছে পদপিষ্ট।

পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে,তখন বাধ‍্য হয়ে আসে পুলিশ,
ভক্তদের জনসমুদ্রের ভেতর থেকে উদ্ধার হয় বেশ কিছু লাশ।
তার মধ‍্যে আদিত্রিও ছিল,সনাক্ত করে আদিদেভ নিজে,
ওর লাল সিঁদুরে রাঙানো মুখ দেখে কেমন যেন পাথর হয়ে যায় আদিদেভ।

নতুন জীবন শুরু হয়ে ওঠার আগেই সব শেষ,
সাক্ষী থাকে আদিদেভের উপহার রক্তমাখা ঝিনুকের হার।
কত পথ চলা ছিল বাকি,কথা ছিল দুজনে মিলে করবে স্বপ্নপূরণ,
ছুঁয়ে দেখবে সাফল‍্যকে,চেটেপুটে উপভোগ করবে জীবনের প্রতিটি স্বাদ,কথা যে রাখল না আদিত্রি।

শ্বশুরমশাইকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও রাখতে পারল না,এই অপরাধ বোধে আদিদেভ পাগল হয়ে যায়,
ওর আদিত্রি,ওর প্রিয়তমা চিরতরে ছেড়ে চলে গেছে ওকে।
যে ট্রেনে করে ওরা দুজন একসাথে হানিমুনে গেছিল সারাজীবন পাশে থাকার অঙ্গীকারে,
সেই ট্রেণে করে আজ নীরব দেহ হয়ে ফিরছে নববধূ আদিত্রি,পাগলপ্রায় আদিদেভ,
ওদিকে পুরিতে আজ উল্টোরথ,ভক্তদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে,"জয় জগন্নাথ।"

Comments

  1. লেখাটি বেশ লাগলো 🙏

    ReplyDelete
  2. চালিয়ে যান। বেশ❤️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আলোর দিশা সাহিত্য পত্রিকা - জানুয়ারী সংখ্যা ২০২৪

মাটির শহর - সৌভিক দেবনাথ

কবি বিকাশ ভৌমিকের কবিতা