অনুভূতির মৃত্যু - সাগর হালদার

অনুভূতির মৃত্যু

                             -সাগর হালদার
      
                                 এক
আমার দিকে ওভাবে কেন তাকিয়ে আছে মেয়েটা, ও কি আমায় চেনে? না, এসব ব‍্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে না ফেলাই ভালো। বাইকটা স্টার্ট দিয়ে শ‍্যামল বেরিয়ে পড়লো বড় রাস্তার দিকে। আজ তার অনেক কাজ। বাজার করবে তারপর বাবার একজন বন্ধুর কাছে কাজের ব‍্যাপারে যাবে। গ্রাজুয়েট করে শ‍্যামল বসে আছে বাড়িতেই। ফার্স্টক্লাস মার্কস থাকলেও বাজারে এখন দারুণ প্রতিযোগিতা। তাই নিজের হাতখরচাটুকুর ব‍্যাবস্থা বাবা একজন বন্ধুর সাথে কথা বলে করে দিয়েছে।
                                   দুই
একজন সোফায় বসতে বলে অপেক্ষা করতে বলেছে শ‍্যামলকে। একঝলকের দেখায় এত আকর্ষণ। সে আগে কখনও এরকম তরুণী দেখেনি- লম্বা চুল, চোখগুলো অনেকটা টানা, মুখের মধ্যে অদ্ভূত মায়া, ঠোঁটে যেনো সবসময় মিষ্টির প্রলেপ আর গা দিয়ে কোনো এক দামি ক্রিমের গন্ধ ভরিয়ে দিচ্ছে চারপাশ।   এরকম মেয়ে দেখা যায় শহরে এখনও! এরা হয়তো ঘরবন্দীই থাকে, রাস্তার ধুলোবালি ঘাঁটে না। শ‍্যামল বুঝলো ওর রাতের ঘুম গেছে। এখন শুধু কাজের ব‍্যাপারে কথাটা মিটিয়ে সে বেরিয়ে পড়তে পারলেই বাঁচে।
                                  তিন
একটা খোলা আকাশ তার নীচে অজস্র মানুষ কেবল ছুটছে, এটাই নাকি জীবন! দীর্ঘশ্বাস পড়লো শ‍্যামলের। কাল থেকে সে বাবার বন্ধুর দেখে দেওয়া চাকরিটায় জয়েন করবে। কম্পিউটার টা জানতো তাই কাজে লেগে গেলো। ব‍্যাঙ্কের ডাটা এন্ট্রি, সই করানো এই কাজটায় একটা দায়িত্ব আছে। হাইট মন্দ ছিলোনা, ছ'ফুটের কাছাকাছি। তবুও বাবা ডিফেন্স লাইনে যেতে দেয়নি। নিজের মতো করে বাঁচা যায় না এ পৃথিবীতে! আরও পড়াশোনা চালানোর ইচ্ছা ছিলো শ‍্যামলের কিন্তু বাবা কাকার ছেলেকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিল কি হবে এত পড়াশোনা করে পাশেই তো দেখছো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বেকার। তার ওপর আর কথা চলেনি। লাল টুকটুকে সূর্যটা ডিউটি শেষে ঘরে ফিরছে এবার শ‍্যামলও বুঝলো তাকেও ফিরতে হবে।
                                   চার
বাইকটা জোরে চালিয়ে সবে রাস্তার বাঁকটা নিয়ে কিছুটা এসে একটা জটলা আর হইহুল্লোড় লক্ষ্য করলো শ‍্যামল। সামনের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই বললো এক তরুণীর একসিডেন্ট হয়েছে। শ‍্যামল এসব ঝামেলায় না জড়িয়ে চলেই যাবে বলে ঠিক করলো কিন্তু 'তরুণী' কথাটা তাকে এগোতে দিলো না। সে ছুটে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলো তাতে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো ক্রমশ। এই সেই তরুণী! শ‍্যামল ভিড়ের মধ্যে থেকে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো, গ্রামের লোকেরাই গাড়ির ব‍্যাবস্থা করে দিলো। সদর হাসপাতালের দিকে যেতে যেতে বাবাকে একটা ফোন করলো তাঁর বন্ধুর নাম্বার নেওয়ার জন্য। আসলে সেদিন কাকুর ফোন নাম্বার নেওয়া হয়ে ওঠেনি ব‍্যাস্ততায়। যে তরুণী সেদিন রাতের ঘুম উড়িয়েছিলো সে আজ তার কোলে শুয়ে। কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছে বোধহয়। এবার কাকুর নাম্বারে ডায়েল করে সবটা এক নিঃশ্বাসে বলে দিলো শ‍্যামল।
                                     পাঁচ
কেমন আছে এখন মেয়েটা?
এক নার্সের কাছে জিজ্ঞাসা করলো শ‍্যামল। কাল রাতে ওকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো। জামায় রক্ত মাখামাখি হয়ে গেছিলো। রাতে সে কোনোরকমেই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। কাকুকে ফোন করেছিলো কিন্তু নেটওয়ার্ক সীমার বাইরে পেয়েছে। এখন তো কাউকে দেখছি না হয়তো সারারাতের পর কোথাও একটা ফ্রেশ হতে গেছে বা বাইরে খাবার আনতে। আমি কি একটু দেখা করতে পারি? ভাবতে পারিনি শ‍্যামল এককথাতেই নার্স রাজি হয়ে যাবে। সে গিয়ে দেখলো তরুণী ঘুমাচ্ছে। পাশে গিয়ে বসতেই চোখ খুলে তরুণী মৃদু হাসি দিলো অস্পষ্ট স্বরে বললো থ‍্যাঙ্কিউ। অনেক অনুভূতি ভিড় করছিলো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু হয়ে উঠলোনা বলা।
                                     ছয়
বাড়ি ফিরতে হবে রেডি হয়ে কাজে যেতে হবে। কোনো কিছুতেই মন বসছিলো না আর। মেয়েটার নাম আজও জানা হয়নি। যখনই সামনে যাই কেন এত বাঁধা আসে? কিছুতেই বলা হয়ে ওঠেনা, মনের মধ্যে ভিড় করে শুধু কথাগুলো। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সব ধোঁয়াশার মতো হয়ে গেলো চোখের সামনে। শুধু এম্বুলেন্সের আওয়াজ টুকু কানে আসছে আর কজন তাকে নিয়ে ছুটেছে কোনো দূর দিগন্তে।
যখন শ‍্যামলের জ্ঞান ফিরলো, ভালোভাবে দেখলো বেডের ওপর শুয়ে আছে সে। একটা ওষুধ এগিয়ে দিয়ে খেয়ে নিতে বললো নার্স। সে জলটার সাথে ওষুধটা গিলে জিজ্ঞেস করলো: কেমন আছে তরুণী?
নার্স উত্তর দিলো: অনেকটা ভালো। কাল ছুটি দেওয়া হবে।
কত নম্বর কেবিনে আছে?
আপনার পাশের কেবিনেই।
উনি আপনার কে হয়?
শ‍্যামল হালকা করে মাথা রাখলো বালিশে, দেখা করতে পারি কী?
না। আপনার বিশ্রামের দরকার।
একটা ভাবনাচিন্তা দূর করার ওষুধ দেবেন?
আপনার চিন্তা না করাই ভালো। দখল পড়বে।
তাহলে ভালো আছে?
হ‍্যাঁ আছে। আপনি বিশ্রাম নিন। একটু পরে ডাক্তার আসবে। আপনার বাবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ভিতরে।
আচ্ছা। যে আমার পাশের কেবিনে ভর্তি তার নামটা যদি একটু বলেন...
নার্স ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে। ফাঁকা কেবিনে শব্দটা নিজের কাছেই ফিরে এলো। শ‍্যামলের মনে হলো, ও কি জানে আমার একসিডেন্টের কথা...।


Comments

  1. অসাধারণ... সত্যিই এমন অনেক কথা থাকে প্রত্যেকের জীবনে যা হয়তো কখনো বলা হয়ে ওঠেনা কাছের মানুষগুলোকে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আলোর দিশা সাহিত্য পত্রিকা - জানুয়ারী সংখ্যা ২০২৪

মাটির শহর - সৌভিক দেবনাথ

কবি বিকাশ ভৌমিকের কবিতা