ঝন্টু গানওয়ালা - সাগর হালদার
ঝন্টু গানওয়ালা
-সাগর হালদার
সময়টা বৈশাখ মাস। গুমোট একটা ভাব থাকলেও অকাল বর্ষণের জেরে সেই অসহনীয় গরমটুকু নেই। এখন একপাল কালো মেঘ এসে দিনকে অন্ধকার করে আনে যখন তখন। 'ঠান্ডা ঠান্ডা পানি সে নাহানা চাইয়ে'-এর জায়গায় 'টিপ টিপ বরষা পানি' গান ভেসে আসছে বাথরুম থেকে। ও হল ছোট্ট ঝন্টু, বয়স নয়-দশ বৎসর। চান করার সময় মাথায় জল পড়লে সবাই একটু গেয়েই ওঠে, তার জন্য গান জানা লাগে না, যাকে বলে বাথরুম সিঙ্গার। সুর-তাল-লয় সব ঠিকরে বেরিয়ে বেসুরো আওয়াজ এসে লাগে বাইরের লোকের কানে। না...না...ঝন্টু সেরকম গায় না, গলা খুব সুন্দর, খালি গলাতেই বাজিমাত করে দিতে পারে। সেই গল্পতেই আসবো, ছোট্ট ঝন্টুর পাড়ার সন্মান বাঁচানোর কাহিনী এই গলা দিয়েই।
এক
ছোট্ট ঝন্টু পাড়ার খুব আদরের, পড়াশোনাতেও ভালো, ক্লাস ফোরে পড়ে, বুদ্ধিও খুব ঘষামাজা। গলার জন্য পাড়ায় বেশ নামডাক, এই তো সেদিনই... পাড়ার '২৫ শে বৈশাখ' অনুষ্ঠানে গানের প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে প্রথম পুরস্কারটা জিতে নিল আর সাথে পাড়ার প্রত্যেকের মন। স্কুলে লেগে থাকা ছোটোখাটো আয়োজিত অনুষ্ঠানেও গান গেয়ে শিক্ষকদের তাক লাগিয়ে দেয় ঝন্টু। শুধু পাড়ায় না, গ্রামের বাইরের কিছু লোকও ঝন্টুকে চেনে, তবে সেটা পটল মামার জন্য। পটল হল পাড়ার খুব পরিচিত মুখ, অদ্ভুত কান্ডকারখানা লাগিয়ে রাখে সুযোগ পেলেই। এই তো...সেদিন, কোথা থেকে একটা ছাগল ধরে এনে তার পিঠে চরে ছপাছপ কঞ্চির ঝাপটা দিতে লাগল আর ছাগলটাও প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল। এক বয়স্ক প্রতিবেশী বাধ্য হয়ে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে বসলো, কি হে পটল, এ আবার তোমার কি পাগলামি? পটল খানিকক্ষণ পরে উত্তর করল, গাধা পিটিয়ে যদি ঘোড়া করা যায় তবে ছাগল পিটিয়ে কেনো হবে না? এমনই আজব কীর্তিকলাপে পাগলা পটলকে সবাই চেনে। না না, ঝন্টুর নিজের কেউ হয় না পটল, পাড়াতুতো মামা হিসাবে তারও মামা। তারই এক কান্ডতে ঝন্টু তার ক্ষুদে প্রতিভা আরও ভালো করে মেলে ধরতে পেরেছিল।
দুই
ঝন্টুর গানের হাতে খড়ি তার মায়ের সুন্দর গলা দিয়ে। বাবার স্বপ্নও ছিল ঝন্টুকে আরেকটু বড়ো হলে গানের স্কুলে পাঠাবে। তা যাই হোক, নীলগঞ্জ গ্রামে স্বরস্বতী পুজো উপলক্ষে একটা বেশ বড়ো অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়, সেখানে কলকাতার বড়ো বড়ো আর্টিস্ট এসে প্রতিবার মনোরঞ্জন করে। প্রচুর দর্শকে ভরে যায়, বড়ো মাঠে ফুল সাজানো স্টেজের চারপাশে লোকজন ভর্তি হয়ে যায়, কেউ আবার ভালোভাবে দেখার জন্য, এর বাড়ির ছাদ ওর আম গাছে উঠে পাকাপাকি ব্যাবস্থা করে নেয়। এবারে খুবই দুঃখের ব্যাপার, যে প্রতিবার অনুষ্ঠান আয়োজনের তৃতীয়াংশ দায়িত্বটাই নেয় সে খুবই অসুস্থ। সবার মুখে একটা দুশ্চিন্তা, তাহলে এবারের মতো অনুষ্ঠান টা কি আর হলো না! কিন্তু সবেতেই মাথা দেওয়া পটল মামার কাজ, এখানেও সুযোগ পেয়ে ঢুকে গেল ম্যানেজিংয়ে ও সবাইকে আশ্বস্ত করল, ওই নাকি কলকাতা থেকে ভালো গায়ক এনে দেবে। সবাই জানে পাগল একটু, সব কাজেই কিছু না কিছু গন্ডগোল করে- তবুও তো উপায় নেই এই দুঃসময়ে। গ্রামের অনেকদিনের ঐতিহ্য এই অনুষ্ঠান, বাইরের লোকও আসে দেখতে, কেউ তো দায়িত্ব নিতেই হবে। তা ওঁর ওপরই দায়িত্বটা ছাড়া হল।
তিন
অনুষ্ঠানের দিন প্রত্যেকবারের মতো এবারেও অনেক লোক, কিচিরমিচির শব্দে মাঠ ভরে উঠেছে আর একটু করে মাইকের শব্দ হলেই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে সবাই। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে আয়োজন একদম ঠিকঠাক। খানিকক্ষণ পর সন্ধ্যাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হল। তারপর সেই আকর্ষণীয় মুহূর্ত, কলকাতার গায়ক গান গাইবে, সবাই অধীর অপেক্ষায়। একপাশে হঠাৎ চোখ পড়তে দেখি, পটল মামা মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে। কি হল! ম্যানেজিংয়ের লোক পর্দার ভেতরে থেকে সব ঠিকঠাক না করে বাইরে কি করছে? যাইহোক, হয়তো বাইরের দিকে দেখতে এসেছে সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ইতিপূর্বে অর্কেস্টার ওঠার সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনো হাঁকডাক নেই, দর্শক এর ওর মুখ দেখছে আর তাড়া দিচ্ছে, কী হল? কিন্তু পটল মামাই বা কোথায়? তারও তো হদিশ নেই।
চার
গ্রামের বদনাম হচ্ছে এভাবে, বাইরের লোক যারা এসেছে কটু ভাষায় গালিগালাজও করছে। ঝন্টু বাবাকে কি একটা কানে কানে বলে স্টেজের পিছন দিকে চলে গেল। খানিকক্ষণ পর স্টেজে আলো জ্বলে উঠল, ও অপূর্ব গলায় ' শিং নেই তবু নাম তার সিংহ' গানটি ভেসে আসতে লাগল স্টেজের পিছন থেকে। সবাই চুপ ও অবাক হয়ে ফাঁকা স্টেজের দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইল। গাইতে গাইতে স্টেজে উঠে আসতেই সবাই দেখল সেই পরিচিত মুখের ঝন্টুকে। দর্শকের হাততালি, বাহবা ভরে গেল মাঠের চারপাশে। অনুষ্ঠান শেষ হতেই ঝন্টুকে নিয়ে একদল লোফোলুফি করতে লাগল আর বলতে লাগল হিপ হিপ হুররে!
সেদিনের পর থেকে কি যে হল সেদিন অনুষ্ঠানে আজও জানা যায়নি, আর পটল মামাই যে কোথায় গেলো সেও ফিরিনি। নিশ্চয় কোনো অদ্ভুত কান্ডই করেছিল তারপর হয়তো কোথাও আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে আয়েস করছে। একদিন তো ফিরবেই সেদিনই জিজ্ঞেস করবো। ঝন্টুর এসব ছাড়াও মনে হয়েছে, সেদিন বাবা-মায়ের চোখের কোণটা কি একটু চিকচিকিয়ে উঠেছিল! ঝন্টুকে বাহবা দেওয়ার সাথে সেদিন মায়েরও কি তারিফ হয়েছিল..!
Comments
Post a Comment